হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের হাওজা ইলমিয়াসমূহের পরিচালক আয়াতুল্লাহ আলিরেজা আরাফি আজ বৃহস্পতিবার, ৪ দেই (ইরানি বর্ষপঞ্জি), পবিত্র আস্থান কুদস রযবীর গ্রন্থাগারের কুদস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আয়াতুল্লাহ আল-উজমা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাদি মিলানির ইন্তেকালের পঞ্চাশতম বার্ষিকী স্মরণ কংগ্রেসে বক্তব্য রাখেন। তিনি এই মহান মারজার ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে শিয়া ইসলামের বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর স্থায়ী ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
দ্বীনি আলেম ও ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃতদের মর্যাদা রক্ষা
ইরানের হাওজা ইলমিয়াসমূহের পরিচালক দ্বীনি আলেমদের ইসলামী আন্দোলন গঠনে ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: সর্বপ্রথম আমাদের স্মরণ করতে হবে ইমাম খোমেইনি (রহ.), মহান মনীষী ও সম্মানিত শহীদদের—যাঁরা এই মহান আন্দোলনের সূচনাকারী ছিলেন। আজকের সব বরকতময় আন্দোলনের শিকড় সেই ঐশী আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত, যা ইমাম খোমেইনি (রহ.)-এর নেতৃত্বে শুরু হয় এবং পরবর্তীতে সর্বোচ্চ নেতার দিকনির্দেশনায় অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আয়াতুল্লাহ আল-উজমা মিলানির (রহ.) পবিত্র আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন: এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের স্মরণ ও সম্মান জানানো আসলে হাওজা ইলমিয়াগুলোর বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের সংরক্ষণ।
মাশহাদের হাওজা ইলমিয়ার ঐতিহাসিক অবস্থান
আয়াতুল্লাহ আরাফি মাশহাদের হাওজা ইলমিয়ার কেন্দ্রীয় ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে বলেন: ইরানের ইতিহাসজুড়ে মাশহাদ ও খোরাসানের হাওজা ইলমিয়া সবসময়ই গভীর শিকড়সম্পন্ন, প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী ছিল। আয়াতুল্লাহ আল-উজমা মিলানির যুগে এই হাওজা সর্বোচ্চ গৌরব ও বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছায়—যার প্রভাব অন্যান্য হাওজা ইলমিয়ার ওপরও পড়ে।
তিনি আরও বলেন: এই কেন্দ্রীয় অবস্থান—যেখান থেকে ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আত্মপ্রকাশ করেছেন—তা আরও গভীরতা, আলো বিকিরণ ও ধারাবাহিকতার সঙ্গে বজায় রাখতে হবে।
আয়াতুল্লাহ মিলানির ব্যক্তিত্বের ছয়টি মৌলিক দিক
দেশের হাওজা ইলমিয়াসমূহের পরিচালক উল্লেখ করেন যে, আয়াতুল্লাহ মিলানির ব্যক্তিত্ব বহুমাত্রিক। তিনি বলেন: এই মহান মারজার ব্যক্তিত্বে ছয়টি মৌলিক দিক চিহ্নিত করা যায়, যেগুলোর প্রতিটির জন্য গভীর ও স্বতন্ত্র গবেষণা প্রয়োজন।
প্রথম দিক: বৈজ্ঞানিক পূর্ণতা ও কৌশলগত ফিকাহি দক্ষতা
আয়াতুল্লাহ আরাফি প্রথম দিকটিকে বৈজ্ঞানিক ও ফিকাহি মাত্রা হিসেবে বর্ণনা করে বলেন: আয়াতুল্লাহ মিলানির ফিকাহ ছিল পূর্ণাঙ্গ ও গভীর। তিনি উসূলুল ফিকাহে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী, ছাত্রগড়া আলেম এবং বিস্তৃত গবেষণার অধিকারী ছিলেন। তিনি এমন সব বিশিষ্ট ছাত্র তৈরি করেছেন, যাঁরা আজ হাওজা ইলমিয়ার অন্যতম বড় শিক্ষক ও আলেম হিসেবে পরিচিত।
তিনি যোগ করেন: আয়াতুল্লাহ মিলানি কেবল শাখাগত আহকামে সীমাবদ্ধ ফকিহ ছিলেন না; বরং ফিকহে আকবর, আকীদা, কালাম, তাফসির ও হাদিসের ক্ষেত্রেও তাঁর শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি ও গভীর চিন্তা ছিল এবং তিনি বহু মূল্যবান রচনা রেখে গেছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন: সমাজের পথপ্রদর্শক হতে হলে একজন ফকিহের ইসলামী জ্ঞান ও আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাব সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা আবশ্যক—এবং আয়াতুল্লাহ মিলানি এই গুণে সমৃদ্ধ ছিলেন।
দ্বিতীয় দিক: নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও ভারসাম্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবন
আয়াতুল্লাহ আরাফি আয়াতুল্লাহ মিলানির নৈতিক দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: তাঁর নৈতিকতা ছিল ব্যতিক্রমী ও উজ্জ্বল। নিষ্ঠা, খ্যাতি ও উপাধি থেকে দূরে থাকা, যুহদ, সংযম এবং পরিমিত আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল এই রাব্বানী আলেমের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
তিনি বলেন: বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক অঙ্গনে তাঁর বহু ভূমিকা ও সমর্থন ছিল নীরব, অপ্রকাশ্য এবং কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; এই নিষ্ঠাই সেই খাঁটি রত্ন, যা আজকের তালিবুল ইলম ও আলেমদের নিজেদের মধ্যে বিকশিত করা উচিত।
দেশের হাওজা ইলমিয়াসমূহের পরিচালক উপসংহারে বলেন: আয়াতুল্লাহ মিলানির আধ্যাত্মিক জীবনধারা ছিল ভারসাম্যপূর্ণ—কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎসারিত এবং চরমপন্থা ও অবহেলা থেকে মুক্ত। এ কারণেই তাঁর নৈতিকতা তরুণ হাওজা শিক্ষার্থীদের জন্য এক স্থায়ী আদর্শে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয় দিক: সামাজিক মাত্রা ও জনগণের সঙ্গে গভীর সংযোগ
আয়াতুল্লাহ আরাফি তৃতীয় দিককে সামাজিক ও জনসম্পৃক্ত মাত্রা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন: আয়াতুল্লাহ মিলানি ছিলেন এমন এক আলেম, যিনি নাজাফে বিকশিত হন, কারবালায় পরিপক্বতা লাভ করেন এবং পবিত্র মাশহাদে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উজ্জ্বলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছান।
তিনি আরও বলেন: সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক সম্পর্ক, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে সক্রিয় উপস্থিতি এবং সমাজের মূল স্রোত থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন না থাকা—এগুলো ছিল এই মহান মারজার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য; একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও চিন্তাবিদদের সঙ্গেও তাঁর বিস্তৃত ও গভীর একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ ছিল।
চতুর্থ দিক: ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব ও হাওজাভিত্তিক রূপান্তর
দেশের হাওজা ইলমিয়াগুলোর পরিচালক চতুর্থ দিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: আয়াতুল্লাহ মিলানি শুধু বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক মারজাইয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক ধারাগুলোর নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায়ও অসাধারণ সক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং মাশহাদের হাওজা ইলমিয়ার রূপান্তরে তিনি এক প্রতিষ্ঠাকালীন ও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন: তাঁর ব্যবস্থাপনার ধারা ছিল ভারসাম্যপূর্ণ—না ভিত্তিহীন আধুনিকতার মোহে আবদ্ধ, না গোঁড়ামি ও স্থবিরতার শিকার; বরং মূল ভিত্তি সংরক্ষণ করার পাশাপাশি নতুন বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাগত দিগন্ত উন্মোচনের ওপর নির্ভরশীল।
পঞ্চম দিক: আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী ঐক্যের চিন্তা
আয়াতুল্লাহ আরাফি আয়াতুল্লাহ মিলানির ব্যক্তিত্বের আন্তর্জাতিক দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: নাজাফ ও কারবালায় তাঁর উপস্থিতির অভিজ্ঞতা এবং বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ প্রমাণ করে যে এই মহান মারজা ভৌগোলিক সীমানার ঊর্ধ্বে এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
তিনি আরও বলেন: তাঁর পত্রালাপ, বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ ও অবস্থান—ইসলামী বিশ্বে এমনকি ইউরোপের সঙ্গেও—ইসলামী ঐক্য, ধর্মীয় সংলাপ ও যুক্তিনির্ভর পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, একই সঙ্গে ফিকহি নীতিমালা ও শরিয়তের প্রতি কঠোর আনুগত্য বজায় ছিল; আর দখলদার ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান ছিল পরিষ্কার ও সন্দেহাতীত।
ষষ্ঠ দিক: রাজনৈতিক ও বিপ্লবী মাত্রা
দেশের হাওজা ইলমিয়াগুলোর পরিচালক আয়াতুল্লাহ মিলানির ব্যক্তিত্বের ষষ্ঠ দিককে রাজনৈতিক ও বিপ্লবী মাত্রা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন: মহান শিয়া মারজাদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা ও ইমাম খোমেইনি (রহ.)-এর আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে আয়াতুল্লাহ মিলানি একটি বিশেষ ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অধিকার করেন।
তিনি যোগ করেন: ইসলামী বিপ্লব মুসলিম বিশ্বকে নিষ্ক্রিয়তা ও আত্মসমর্পণ থেকে কর্মতৎপরতা, সক্রিয় প্রতিরোধ ও চিন্তা-উৎপাদনের দিকে পরিচালিত করেছে, এবং আয়াতুল্লাহ মিলানি ছিলেন সেই সব মারজার একজন, যিনি ইসলামী আন্দোলনের এই মহান বার্তাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন এবং তার প্রতি সমর্থন জানান।
আয়াতুল্লাহ আরাফি শেষে আশা প্রকাশ করেন যে: মাশহাদের হাওজা ইলমিয়া ও অন্যান্য হাওজা ইলমিয়াগুলো আয়াতুল্লাহ আল-উজমা মিলানির বৈজ্ঞানিক ও কর্মজীবনের আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামী বিপ্লবের আলোকোজ্জ্বল পথ অব্যাহত রাখবে এবং তরুণ তালিবুল ইলম ও ফাজেলগণ ইসলামী বিপ্লব ও সম্মানিত শহীদদের আদর্শ বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
আপনার কমেন্ট